আর্নেস্ট হোমিংয়ের "দ্যা ওল্ড ম্যান এড দ্যা সী" বইটি পড়তে বসেছিলাম।কিন্তু ঘুমে চোখ এতোটাই ভারী হয়ে আছে,মনে হচ্ছে চোখের অক্ষি কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।

হঠাৎ করে শুনতে পেলাম,কে যেন বিড় বিড়  করে কিছু একটা বলছে আমাকে।কন্ঠস্বর টা অনেক বড়,পুরুষালি কন্ঠ।কি বলা হয়েছে সেটা আমি ধরতে পারি নি।যেহেতু রুমে কেউ নেই,তাই হতে পারে আওয়াজটা বাইরে থেকে এসেছে।ধাক্কা দিয়ে দরজা খুললাম,কিন্তু বাইরে কেউ নেই।হতে পারে এটা ক্লান্ত মস্তিষ্কের অবচেতন কল্পনা।

প্রায় মধ্যরাত হয়ে গেছে-এই সময় আমার সাধারণত ঘুম আসে না।আর যদি খুব বেশি ঘুম পায় তাহলে সেটা সারা রাত না ঘুমানোর লক্ষণ।প্রায়ই এরকম হয়।চোখে প্রচন্ড ঘুমের চাপ থাকে,কিন্তু ঘুম আসে না।তারপরও ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিলাম।এক গ্লাস পানি পান করে, মশারি টানিয়ে বিছানায় গেলাম।ফাল্গুন মাস প্রায় শেষের দিকে,আজকে তাপমাত্রা অনেক বেশি।প্রচন্ড গরম অনুভব করছি।মশার নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মশারি টানিয়েছি।মাথার পেছনের চেয়ারে একটা টেবিল ফ্যান ও রাখা আছে।কিন্ত মশারির ভেতরে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে না।ফ্যানটাও আকারে অনেক ছোট।

মশারির উপরের দিকটা ঢিলা হয়ে অনেকটা ঝুলে আছে,প্রায় শরীর ছোঁই ছোঁই অবস্থা।তারপরও আমার শরীর থেকে দুই ইঞ্চি উপরে মশারির অবস্থান।তার মানে এই দাঁড়ালো- মশারিতে বসে যদি মশা আমার শরীরে সুঁচ ফোটাতে চায়,তাহলে তার দুই ইঞ্চি লম্বা সুঁচের দরকার।যেহেতু মশার এতো লম্বা সুঁচ নেই,তাহলে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়।প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছি কিন্তু ঘুম আসছে না।ঘুম আসার যতোরকম কায়দা আছে সবক'টা অনুসরণ করতে লাগলাম।

যেমন -
একশো থেকে উল্টো গুণে গুণে এক পর্যন্ত আসতে হবে।এতে যদি কাজ না হয় তাহলে চোখ বন্ধ করে বৃত্ত কল্পনা করতে হবে এবং সেগুলা ভরাট করতে হবে।বিশেষজ্ঞদের মতে এরকম পদ্ধতি অনুসরণ করলে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয় এবং  তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে।কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটলো তার উল্টোটা।চোখের ঘুম যা ছিলো সব চলে গেছে।বিশেষজ্ঞরা বলেছেন একশো থেকে উল্টো গুণতে হবে।আমি ভাবলাম দুইশো থেকে গুণলে সমস্যা কি?এক গুণায় ঘুম চলে আসবে।কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর সংখ্যায় তালগোল পাঁকিয়ে ফেলছি।ভাবলাম শুয়ে শুয়ে সঠিক ভাবে গণনা করা সম্ভব নয়।তাই উঠে বসে পুনরায় গণনা শুরু করলাম।গণনা ঠিকই হয়েছে কিন্তু ঘুম বেচারা পুরোটা উধাও হয়ে গিয়েছে।তাই ভাবলাম "দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সী " বইটি নিয়ে আবার বসা যাক।

বিছানা থেকে উঠতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো।সচরাচর এখানে লোডশেডিং হয় না।হয়তো আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ।ফাল্গুন মাসেও বজ্রের ডামা-ঢোল বাজিয়ে বৃষ্টি হওয়াটা অবাস্তব কিছু না।পূর্বপাশের জানালাটা খুলে দিলাম।বাইরে চাঁদের জোছনা মিটিমিটি করছে।আকাশে তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে।অর্থাৎ বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই।হয়তো অন্যকোনো কারণে লোডশেডিং হয়েছে।ফ্যান বন্ধ হওয়ায় মশার উৎপাত বেড়ে গেলো।তাই আবারো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

মশারিটা মুখ থেকে প্রায় তিন ইঞ্চি উপরে ঝুলে আছে।মনে হচ্ছে প্রায় ডজনখানেক মশা সেখানে বসে ননস্টপ সংগীত পরিবেশন করছে।এই গান আর থামবে বলে মনে হয় না।ভন ভন  আওয়াজে কানটা একেবারে জ্বালা-পালা হয়ে যাচ্ছে।আমি নাছোড়বান্দার মতো বিছানায় পড়ে আছি প্রতিবাদ করার মতো কোনো অস্ত্র আমার কাছে নেই।তাছাড়া আমার অর্থনীতির স্যার বলেছেন মশা মারলে নাকি বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে।যদি সব মশা মেরে ফেলা হয় তাহলে কয়েল কোম্পানিতে ধ্বস নামবে,মশারি কোম্পানিতে ধ্বস নামবে।কোম্পানি গুলো আর শ্রমিক নিয়োগ দেবে না।তাতে বেকারত্বের হার বাড়তে থাকবে।দেশের বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে মশার উপর পাল্টা আক্রমণ করলাম না।তবে রক্ষণাত্বক ভঙ্গিতে ওদের সাথে মোকাবেলা করা যায়।

দুই হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরলাম,তারপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।কিন্তু এভাবে কতোক্ষণ থাকবো,প্রায় পাঁচ মিনিট পরে হাল ছেড়ে দিলাম।এবার মনে হচ্ছে শব্দ এবং স্বর ঠিকই আছে কিন্তু সংগীতের তাল পরিবর্তন হয়েছে।অনেকটা এরকম- ভন-----ভন-----ভনভন-----ভনভন---- ভন।
মনে হচ্ছে ওরা রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করছে।পীথাগোরাস বলেছিলেন সবকিছুর মধ্যে সংগীত নিহিত রয়েছে।তাই তিনি গণিতের মধ্যে ও সংগীত খোঁজে পেয়েছেন।আইনস্টাইন তো পিয়ানোর সুরের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খোঁজে পেতেন।এই দিক বিবেচনা করলে মশার ভন ভন আওয়াজে রবীন্দ্র সংগীত খোঁজে পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।

এক ঝটকায় বিছানা থেকে উঠে পূর্ব দিকের জানালার পাশে গিয়ে বসলাম।আবাসিক হল থাকার কারণে রুমটা অনেক বড়।রুমের চার কোণায় চারটি বেড এবং চারটি টেবিল আছে।রুমের বাকি তিনজন মুসাফিরের মতো ওরা শুধু পরীক্ষার সময় আসে তারপর আবার উধাও।সবসময় রুমে একা থাকতে হয়।কথা বলার মতো কেউ নেই।তাই বলে কি আমার কথা বলা বন্ধ? দেয়ালের সাথে কথা বলি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলি।কখনো আয়নার দিকে তাকিয়ে ডেল কার্নেগির মতো বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করি,মাঝে মধ্যে রোহান এটকিনসনের মতো নানারকম ভঙ্গিতে মুখ ভেংচিয়ে নিজেকে হাসানোর চেষ্টা করি।আয়নায় ফুটে ওঠা নিজের অদ্ভূত অঙ্গসঞ্চালন বিদ্যা দেখে কিছুটা অবাক হই।আফসোস করে বলি-সব কিছু ছেড়ে যদি অভিনয় বিদ্যাটা রপ্ত করতে পারতাম!

যাই হোক বিভিন্ন ভাবে নিজেকে খুশি রাখার চেষ্টা করি।তবে একজন মায়াবতীর মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম।এক সময় আবিষ্কার করতে পারলাম আমার হাসি কান্না অনেকটা ওর উপর নির্ভর করে।সে হাসলে আমি হাসি,সে কাঁদলে আমি কাঁদি।
-কিন্তু কেন?
-আমার হাসি কান্না কেন অন্যকেউর উপর নির্ভর করবে?নিজেকে প্রশ্ন করলাম।
-আমার সুখ-দুঃখের নিয়ন্ত্রক কেন অন্য কেউ হবে?।
তারপর নিজের সাথে সংগ্রাম করে সেই মায়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসলাম।

তবে সেই মায়াবতী কী জানতো কেউ একজন তার মায়ায় আটকা পড়েছিল,এবং তার অজান্তেই সেই মায়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।

-হয়তো জানে না।অনেক কিছুই আছে যা অজানা থেকে যায়।অনেক রহস্যই আছে যা উদঘাটন করা যায় না।

জানালার সবকটা পার্ট খুলে দিলাম।রাশি রাশি জোছনায় গা ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে,কিন্তু চাঁদটা মধ্য আকাশ পেরিয়ে পশ্চিম প্রান্তে ঢলে পড়ছে।তাই তির্যকভাবে রুমে আলো প্রবেশ করতে পারছে না।কারন জানালাটা পূর্ব প্রান্তেই ছিল।তারপরও অন্ধকার রুমে জোছনা গুচ্ছ লুটুপুটি খাচ্ছে।এমন একটা পরিবেশে যদি হাতে একটা জলন্ত সিগারেট থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। পকেটে মাত্র দুটি সিগারেট আছে, এখন একটা এবং শেষ রাতে একটা। খেল খতম।
দেশলাই এর পুড়া গন্ধটা নাকের মধ্যে জোরালো ধাক্ষা দিলো।এই গন্ধটা আমার অনেক ভালো লাগে।বাঁকা ঠোঁটে সিগারেটে তৃপ্তির টান দিয়ে এক গাল ধোঁয়া নাসারন্ধ্র দিয়ে নিক্ষেপ করলাম।ধোঁয়ার কুন্ডুলি পাঁক খেতে খেতে হাওয়ায় মিশে গেল।চোখ বন্ধ করে বড় করে তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিলাম।
হঠাৎ করে স্পষ্ট স্বরে মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।একটা মেয়ের হাসি,খুবই মিষ্টি স্বরে হাসছে।এই হাসি আমার অনেক পরিচিত।এই হাসিটা সেই ময়াবতীর হাসি।
এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম।কিছু একটা গোলমেল তো হচ্ছে।

হাসির শব্দটা খুবই স্পষ্ট ভাবে শুনলাম।মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতর থেকে শব্দটা বের হচ্ছে।গত কদিন ধরে মাথার মধ্যে চাপা যন্ত্রনা অনুভব করছিলাম।সব কিছুর পেছনে কোন না কোন যুক্তি আছে,আমি এটা বিশ্বাস করি।এই ঘটনার পেছনেও কোন যুক্তি আছে সেটা আমাকে খুঁজে বের করতে হবে।তার মানে বিড়্ বিড়্ করে পুরুষালি কন্ঠে যে আওয়াজটা শুনেছিলাম সেটা আমার মস্তিষ্কের ভুল ছিল না।রাত প্রায় দুটো বাজে,আর কোন দিন এরকম পরিস্থিতির সম্মুখিন না হওয়ায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম।যদিও যুক্তি দিয়ে ভয় কে জয় করা যায় কিন্তু এর পেছনে শক্তিশালি যুক্তি প্রয়োজন।তবে শুনেছি পাগলরা নাকি এরকম অদ্ভুত কিছু শুনে,অদ্ভুত কিছু দেখে।ভয়ে কাতর ভঙ্গিতে জরসর হয়ে ঘরের কোনে বসে থাকে।অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের কথা বলে,বিশেষ কোন বিষয়কে নির্দেশ করে।কেউ আবার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে,ভয়ংকর ভঙ্গিতে অট্রহাসি দেয়।আবার আরেক শ্রেণীর পাগল আছে যারা এক যায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকে এবং এক দৃষ্টিতে কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকে।

,,,,চলবে

লেখক- মাহফুজুর রহমান