ডুম ২



মাঝে মাঝে যখন বিধ্বংসী মেজাজে থাকি, এই সিরিজ নিয়ে লিখতে ইচ্ছা হয়। যাই হোক, আগের পর্বে ডুম নিয়ে অনেক মজা করেছিলাম, ডুম কিন্তু সিরিয়াস জিনিস। এই নিয়ে ৫ বার পৃথিবীতে কেয়ামত নেমেছে, ৫ বার থ্যানস এসে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে ৫০% এর বেশি প্রজাতি। এই ঘটনাগুলোর নাম 5 major extinctions.

১। অর্ডোভিশিয়ান-সিলুরিয়ান এক্সটিঙ্কশনঃ   আজকের দিনে হু হু করে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে, কিছুদিন পর তাপমাত্রা বেড়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে ডুবে মরার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। আজ থেকে ৪৪.৪ কোটি বছর আগে অবস্থা ছিল উলটা।
৪৪.৪ কোটি মানে সুবিশাল অতীত। মাটিতে তখন কোন প্রাণী নেই, নেই গাছপালা। পানির নিচে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ট্রাইলোবাইট, গ্র্যাপ্টোলাইট আর আদিম মাছের দল। (হুদাই নাম বললাম, কেউ কিছু বুঝবে না, বাট ভাব নেওয়া যায় এগুলা বললে। )
সেই সময় আমেরিকায় অ্যাপালেশিয়ান পর্বতমালার জন্ম হচ্ছিল। এই পর্বতমালা জন্মের সময় কিভাবে জানি কিছু সিলিকেট পাথরকে এক্সপোজ করে দেয়। এই হারামিগুলো বাতাস থেকে CO2 শুষতে থাকে। CO2 র অভাবে পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়ে জমে বরফ হয়ে যায়। সমুদ্র ঢেকে যায় বিরাট এক বরফের চাদরে। এই সময় মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো মাত্র ৬০০০ আলোকবর্ষ দুরে একটা হাইপারনোভা বার্স্ট করে (হতচ্ছাড়া তারাটা মরার আর টাইম পেল না) ।

ঠাণ্ডায় জমে, রেডিয়েশানে ঝাঁঝরা হয়ে মারা যায় ৮৬% প্রজাতি। বাঁচে মাত্র ১৪%।

২। ডেভোনিয়ান এক্সটিঙ্কশনঃ ডেভোনিয়ান আমার খুব প্রিয় একটা যুগ - সেই সময় সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতো বিশাল সব দানব মাছরা, আর মাটিতে গজাত দানবাকার ব্যাঙের ছাতা। এই যুগ নিয়ে ফুল আর্টিকেল লেখার ইচ্ছা আছে, ডিটেইল সেটার জন্য তুলে রাখলাম।


আজ থেকে ৩৭.৫ কোটি বছর আগে ডেভোনিয়ানবাসির জন্য থ্যানস নেমে আসে। হয়েছিলো কি, সেই সময় মাটিতে গাছ খুব বেড়ে গিয়েছিল। গাছগুলো প্রচুর খাওয়া দাওয়া করত, তরতর করে বাড়ত, একেকটা লম্বা হতো ২০-৩০ তলা বাড়ির সমান। এদের পাতা আর ডালপালা মাটিতে পরে প্রচুর সার হত। সেই সার পানিতে যেয়ে পানি ছেয়ে গেল নানান জাতের শেওলায়। কোটি কোটি শেওলা যখন মরত, এদের পচানোর জন্য লাগতো কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়ারা পানি থেকে সব অক্সিজেন শুষে নিলো।

গাছে ভরা সবুজ সমুদ্রে অক্সিজেনের অভাবে লাশ ভেসে উঠলো দানব মাছদের। ৭৫% প্রজাতি শেষ। বেশি গাছ হলে কি হতে পারে ভাবলে গা শিউরে ওঠে।

৩। পারমিয়ান ট্রায়াসিক এক্সটিঙ্কশনঃ পারমিয়ান যুগ ছিল ম্যামাল-লাইক-রেপ্টাইলদের যুগ। আমার পার্মিয়ান লেখাটায় এদের নিয়ে ডিটেইল লিখেছি, পড়ে আসতে পারেন।

পারমিয়ান বিস্তারিত

২৫ কোটি বছর আগে পার্মিয়ানবাসির উপর একেবারে কেয়ামত নেমে আসে। ঠিক কি হয়েছিলো কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। ধারণা করা হয় একটা না, অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল। কিছু ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি বাতাসে CO2 এর পরিমাণ খুব বাড়িয়ে দেয়। একই সময় কিছু শয়তান মিথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া বাতাসে মিথেন ছড়াতে থাকে। তাপমাত্রা বেড়ে যায় অনেক। বাতাস থেকে নেমে আসে অ্যাসিড বৃষ্টি। সমুদ্রের পানি থেকে বুদ্বুদের মতো বেরোতে থাকে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস।

ভয়াবহ বিষাক্ত পরিবেশে ধুঁকে ধুঁকে মরে পৃথিবীর ৯৬% প্রজাতি। এই বিষাক্ত পরিবেশকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পৃথিবীর তিন কোটি বছর লেগেছিল। এই তিন কোটি বছর পর বাকি ৪% প্রাণী থেকে শুরু হয় প্রাণের নতুন যাত্রা, আসে সরীসৃপদের যুগ।

৪। ট্রায়াসিক-জুরাসিক এক্সটিঙ্কশনঃ পারমিয়ান এক্সটিঙ্কশনের ৫ কোটি বছর পর, আজ থেকে প্রায় বিশ কোটি বছর আগে, আর একবার মহাবিপর্জয়ের মুখে পরে পৃথিবী। এবারের ধ্বংসটা সবচেয়ে রহস্যময়, কোন একক কারণ এখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

কারো কারো মতে, বিশাল কিছু উল্কাপাত এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ। এবারের এক্সটিঙ্কশন ইভেন্টে ধ্বংস হয় প্রায় ৮০ ভাগ প্রাণী, রাজত্ব শুরু হয় ডাইনোসরদের। উল্কাপাতের কাহিনী সত্যি হলে, এক উল্কাপাতের মাধ্যমে ডাইনোসরদের যাত্রা শুরু, আরেক উল্কায় তাদের মরণ।

৫। ক্রেটাসিয়াস-ট্রায়াসিক এক্সটিঙ্কশনঃ এটার কথা আমরা সবাই জানি। আসলে, শুধু এই ধ্বংসের কথাই লোকজন জানে, বাকি চারটার নামও শুনে নি।

এবারের কালপ্রিটটার নাম চিক্সালাব। সে একটা অ্যাস্টেরয়েডের টুকরা। দানবীয় উল্কাটার সাইজ ধারণা করা হয় ১১ থেকে ৮১  কিলোমিটার পর্যন্ত। মেক্সিকোর চিক্সালাব অঞ্চলে সে যেই ক্ষত রেখে গেছে তার ব্যাস ১৫০ কিলোমিটার।

ডাইনোসর ধ্বংসের আমরা যেই ছবিটা মনে মনে চিন্তা করি - বিরাট বড় একটা উল্কা আঁচড়ে পড়ল আর ডাইনোসররা সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো, ব্যাপারটা আসলে সেরকম না। মৃত্যু জিনিসটা স্লো, করুণ, ভয়ঙ্কর। উল্কাপাতে আশেপাশের প্রাণীরা মারা যায় ঠিকই, সাড়া পৃথিবীতে তার প্রভাব ছড়িয়ে পরতে সময় লাগে। উল্কার ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পরে, একেবারে স্ট্রাটোস্ফিয়ার পর্যন্ত। সূর্যের আলো আসা খুব কমে যায়। পৃথিবীটা তখন ঘন কালো মেঘাচ্ছন্ন জগত। আলো আসা খুব কমে যাওয়ায় বড় বড় গাছরা মরে সালোকসংশ্লেষণের অভাবে। না খেতে পেরে আস্তে আস্তে মারা যায় বিশাল তৃণভোজী ডাইনোসররা। শেষে মারা যায় তাদের খেয়ে যারা বেঁচে থাকতো সেইসব মাংসাশী প্রাণীরা।

কতদিন ধরে মড়ক চলেছিল বিতর্ক আছে। কেউ বলে কয়েক বছর, কেউ বলে কয়েক হাজার। পৃথিবীর ৭৫ ভাগ প্রাণী এই মহাধংসজজ্ঞে মারা যায়। কিছু কুমির ছাড়া, ২৫ কেজির বেশি ওজনের কোন মাটির প্রাণী রক্ষা পায় নি। একমাত্র পাখি ছাড়া প্রায় সব ধরনের ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাগরে ভাসতে থাকে মোসেসর আর প্লেসিওসরদের লাশ।

৬। হলোসিন এক্সটিঙ্কসনঃ এটা ৬ নম্বর মহা বিপর্যয়। কবে আসবে? অলরেডি শুরু হয়ে গেছে।
এই বিপর্যয়ের কারণ মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া না। বাতাসে CO2 বেড়ে যাওয়াও না। আসলে, হাজারটা ছোট ছোট কারণ খুঁজার দরকার নাই।
এই বিপর্যয়ের কারণ, এক কথায় মানুষ।

৪০ হাজার বছর আগে যখন মানুষ প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায় সেখানে ক্যাঙ্গারু টাইপের অনেক জাতের
মারসুপিয়াল ছিল। একটা একটা করে সব কয়টাকে খুন করা হয়েছে। শিকার করে করে বিলুপ্ত করা হয়েছে ম্যামথ আর ডোডোদের। মাদাগাস্কারে থাকতো সুবিশাল হাতিপাখি , মানুষের অত্যাচারে টিকতে পারে নি।

ঠিক কতগুলো প্রজাতি মানুষ ধ্বংস করেছে, আর কতগুলো করবে আমি জানি না। তবে, ১৯৭০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গত ৪৯ বছরেই পৃথিবীর মোট মেরুদণ্ডী প্রাণীর ৬০ ভাগ জনসংখ্যাকে খুন করেছে মানুষ।


https://www.google.com/amp/s/amp.theguardian.com/environment/2018/oct/30/humanity-wiped-out-animals-since-1970-major-report-finds

যারা ডাইনোসরের ধ্বংস দেখতে পারে নি বলে আফসোস করেছে, তাদের আফসোস করার কিছু নেই, আর কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণী শেষ করে ফেলব আমরা!